‘পরমচেতনার পথে কবিতা’-একটি সমালোচনা।
অর্ণব মিত্র
আজকাল আধুনিক কবিতার পাঠক কমছে। জনপ্রিয় কবিতা পত্রিকাগুলিতে নামি ও অনামি কবিদের যে সব কবিতা ছাপা হয় তা পাঠককে আর টানছেনা। প্রকাশিত কবিতার মধ্যে দুয়েকটি হয়ত ভালো লাগছে পড়তে । বড় বড় কবিতা সংকলন বা জনপ্রিয় কবিতা পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় অনেক কবিতাকে স্থান করে দেওয়া হচ্ছে । কিন্তু শেষ অবধি পড়লে বোঝা যায় বেশিরভাগ কবিতা ভাবনার দিক দিয়ে স্পষ্ট না হয়ে উঠে শেষে বিমূর্ততার দিকে চলে যাচ্ছে । বেশিরভাগ কবিতা কয়েক লাইন পড়ার পর আর এগোন যাচ্ছে না। বা পুরো কবিতা পাঠ করে বা পড়ে গেলেও সেভাবে কোন মানে তৈরি হচ্ছে না। মনে হয় এলোমেলো ভাবনার উপরে কিছু শব্দ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজকাল কি কবিরা মনে করেন আধুনিক কবিতার নামে কিছু একটা লিখে দিলেই চলবে বা ভাবনার রেশ বা অনুরণন দিলেই হবে। স্পষ্ট করে কোনো ভাবনাকে ধরবার দরকার নেই। নাকি এই সময়ের কবিরা নতুন করে আর কোনো ভাবনা নিয়ে আসতে পারছেন না।
একবার বহরুমপুরের কবি অভিজিৎ রায় একটি জনপ্রিয় পত্রিকার কোনো একটি সংখ্যায় ছাপা কবিতা সমন্ধে বলেছিলেন সেই সংখ্যায় ছাপা সমস্ত কবিতার শিরোনামগুলি সরিয়ে নিয়ে পড়লে মনে হবে সমস্ত কবিতাই একজন কবির লেখা। তাই সামগ্রিক ভাবে আমি মনে করি গত দুই দশকে কবিতার পাঠক অনেক কমে গেছে। কেউ আর কবিতা-নামক প্রকাশ মাধ্যমটি নিয়ে আর ভাবতে রাজি নয়।
এরকম একটি অবস্থায় হাতে পেলাম কবি অরুণ দাস-এর লেখা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের বই ‘পরমচেতনার পথে কবিতা’ যা কবিতা বিষয়ক ভাবনাকে নতুন করে জাগিয়ে দিতে পারে। যার ভূমিকা লিখেছেন কবি,গদ্যকার ও সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী। কবি অরুণ দাস-এর মতে কবিতার মধ্যে দিয়ে পরম চেতনায় যাওয়া সম্ভব। যদিও বইয়ের বিষয়টি একটি অন্য পথের সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তা আধ্যাত্মিকতার দিকে নিয়ে যায় তাও এই ভাবনা বর্তমানের কবিতা চর্চার আশাহীন জগতে একটু হলেও উৎসাহ তৈরি করবে ও এই বইয়ের বিষয়টি তরুণ কবিদের ও পাঠকদের নতুন ভাবনার পথে চালিত করবে সন্দেহ নেই।
১
জগৎ ও সৃষ্টি সমন্ধে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মধ্যে মহাভূতবাদ একটি অন্যতম। এটি পঞ্ছতত্ত্ববাদ নামেও পরিচিত। এই বিশ্ব শুধু পাঁচটি উপাদানের খেলা। এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান পঞ্চভূত নামে পরিচিত। মনও এই পাঁচটি উপাদানের যোগফল। পরমচেতনার জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে গেলে তাই ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন। মনকে বলা হয় ষষ্ঠ জ্ঞানেন্দ্রিয়। পাঁচটি ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধির উপরে উঠে মন পরমচেতনার দিকে এগিয়ে চলে।
চোখ আমাদের দর্শনের অনুভূতি তৈরি করে। দৃষ্টির সূক্ষ্মতা কবি ও পাঠকের সামনে খুলে দেয় নতুন ভাবনার পথ। লেখক দেখিয়েছেন দেখার সূক্ষ্মতা থেকে তৈরি কবিতার লাইন অনুভবের গভীরে ঢুকে পাঠককে পরমচেতনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার কয়েকটি প্রয়োগ দেখিয়েছেন কবি অরুণ দাস।
যেমন মাতাল সন্ধায় এ ম্রিত্যু
এঁকে রাখি চোখের জলে
বা বন্ধ চোখ
অনায়াসে ছুঁয়ে ফেলে
উদাস জ্যোস্না।
কবি অরুণ দাস-এর মতে কবি এই পঞ্চভূতকে উপলব্ধি করতে পারলে বা আয়ত্তে আনতে পারলে, তিনি কবিতা সৃষ্টির উপরেও একধরণের বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করতে পারবেন। তাঁর মতে অভ্যাসের দ্বারা পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কোনো একটি ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বাড়িয়ে অন্য ইন্দ্রিয়গুলির সক্রিয়তা বাড়ানো যায়।
সেভাবেই কান বা শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের চালনা করে আমরা পৌঁছতে পারি পরমচেতনায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি লিখেছেন
‘ তোর মনে পড়ে অসংখ্য উদাস তারা, আর নির্মেঘ আকাশের নিচে সে সব সবুজ আর্তনাদ?
আর এভাবেই নাসিকার সক্রিয়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘ্রাণেন্দ্রিয়র ক্ষমতা বাড়িয়ে দর্শন ও শ্রবণের অনুভূতি পাওয়া যায়।
যেমন ‘ তোর পোশাকের গন্ধে
থেমে যায় শহর।
বা
‘আজ বুনো গাছের গন্ধে নেমে আসে অন্ধকার
সেভাবেই ত্বকের সক্রিয়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে লেখক মনে করেন কবিতায় অনুভূতি তৈরি করা যাবে
‘ স্নিগ্ধ কাশের মেঘে মেঘে থাকি
বর্ষাভীরু চোখে
আধো ঘুম অন্ধকারে।
বা
তোমাকে লিখি
শুধু স্পর্শে নয়
অনুভবেও ভালোবাসা হয়।
২
৫৫ পাতার এই বইতে লেখক বারবার z প্রজন্মের কবিতাকে পরমচেতনার কবিতা বলেছেন। তবে পরমচেতনা কি !- এর সুস্পষ্ট ভাবে কোন হদিশ বইটি জুড়ে তিনি দিতে পারেননি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ হতাশা নিরাশাই কবিতায় রুপ পায় শব্দের মধ্যে দিয়ে। তাই আধ্যাত্মিক উত্তরণ হলে একজন কবির কবিতা লেখার নান্দনিক ক্ষমতা যে বেড়ে যাবে- যা এই বইতে লেখক দাবি করেছেন তা বাস্তবে হবে এমন কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।