paramchetanar-pothe

জেড প্রজন্মের কবিতা। ব্যাপারটি বিষয় হিসেবে একেবারেই নতুন অনেকের কাছেই। কারণ, সাধারণত জেড প্রজন্ম বলতে আমরা বয়সে নবীন,জ্ঞান-বুদ্ধিতে পরিনত আজকের তরুণ দলের কথা জানি; যারা প্রাযুক্তিক বিকাশের নিরিখে মানবজাতির সর্বশেষ প্রজন্ম। এই শতাব্দী অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত যারা জন্মেছে সেই প্রজন্মের আন্তর্জালিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পটুত্ব, বাস্তববাদী জীবনচেতনা আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একইভাবে,যুগসমস্যায় অতিষ্ঠ এই প্রজন্মের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীরই প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,ভাববিলাসে তাদের মন তেমন নেই। স্বাভাবিকভাবেই,জেড প্রজন্মের কবিতা বিষয়টি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলাম।যদিও এই বিষয়ে লিখিত প্রথম বইটি(লেখক- অরুণ দাস মহাশয়) পড়ার সৌভাগ্যহেতু খানিক ধারণা ছিল বিষয়টি সম্পর্কে। পাঠপ্রতিক্রিয়াও লিখেছিলাম বইটির। এবার হাতে এলো লেখকের দ্বিতীয় বইটি। তবে এই বইটি কবিতার নয়, Z-প্রজন্মের কবিতা অন্দোলনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু তাত্ত্বিক কথা আলোচিত হয়েছে এখানে। কেন লিখবো, কি লিখবো এবং কিভাবে লিখবো…সেই সংক্রান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনাও আছে।

আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, Z-প্রজন্মের কবিতা ‘পরমচেতনা’র কবিতা। এবং সেই শর্ত অনুসারে,
শব্দ নয়, বর্ণ-ই ব্রহ্ম।
ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে সবিশেষ গ্রহণ করার অঙ্গীকার করা উচিত। এখন আলোচনার প্রারম্ভেই আমাদের ভাবতে হবে,
‘কিভাবে ছুঁয়ে ফেলা যায় পরমচেতনার অনুভবকে?’

লেখকের কথাতেই বলি, ‘পরমচেতনার জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে গেলে ইন্দ্রিয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতাবৃদ্ধি ও বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সুসমন্বয়ে পরমচেতনার সূক্ষ্ম অনুভূতিকে সহজেই অনুভব করা যায়।
বিশেষত, কবিতা পাঠে চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বার ভূমিকা সর্বশ্রেষ্ঠ। এই ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে কবিতার দর্শন-শ্রবণ-পাঠের অনুভব ও স্পন্দন, অন্য ইন্দ্রিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সঞ্চারিত হয়। ফলে অন্য ইন্দ্রিয়ের অনুভব শক্তিও আরো অনেক শক্তিশালী, সূক্ষ্মতর এবং গভীরতর হয়।
কবিতার সৃষ্টি ও অনুভবে ত্বক কিংবা নাসিকার ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর্ণ-শব্দ-ধ্বনির অনুরণন, স্পন্দন, কম্পন কবি ও পাঠকের ত্বক, জিহ্বা এবং নাসিকা সরাসরি গ্রহণ করতে পারে। ফলে তাঁরা কবিতার বিভিন্ন বস্তু বিষয়কে সরাসরি অনুভব করেন।
সুতরাং,পরমচেতনাকে উপলব্ধি করতে গেলে ইন্দ্রিয়জ্ঞান তাই অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। আমাদের পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা, ত্বক), পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক, পানি, পাদ, পায়ু, উপস্থ) ছাড়াও আরও চারটি অন্তরিন্দ্রিয় আছে। এগুলি হল মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার। পরমচেতনার অনুভবে এই চারটি অন্তরিন্দ্রিয়ের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানুষ মাত্রেই মননশীল প্রাণী এবং মননশীলতার রুচিশীল সৌকর্য বিন্যাস না হলে কখনও কবিতার মতো অতীন্দ্রিয় কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব হয়না, একথা অনস্বীকার্য।

লেখকের আলোচনায় মনকে আমাদের ষষ্ঠ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের স্থান দেওয়া হয়েছে। কারণ, এই ইন্দ্রিয় আমাদের জীবন যাপন, শিল্প-সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা ছাড়াই বোঝা যায়। তাই এটি ইন্দ্রিয়াতীত, অতীন্দ্রিয় সত্তা।’
কারণ, লেখকের কথা টেনেই বলি, ’বস্তু-বিশ্বের মধ্যে অন্তর্লীন সৌন্দর্যময় অন্তর্নিহিত অবস্থাকে প্রত্যক্ষ করা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করা একমাত্র পরমচেতনায় সম্ভব। এতে বস্তু-বিশ্বের প্রকৃত অবস্থা ও স্বরূপ কবির কাছে ধরা দেয়। তাঁর সৃষ্টি হয় সর্বজনীন ও সর্বকালীন।’
সেই সূত্র ধরেই বলা যায়, আমাদের চেতনার সর্বোচ্চ স্তরে অর্থাৎ, পরমচেতনায় আমাদের পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের শক্তি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। তাই পরমচেতনার কবিতা নির্মাণে পঞ্চইন্দ্রিয়ের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এবং এই অভিনব পন্থাটি কিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, তা আলোচনা করার জন্য অবশ্যই ইন্দ্রিয়সমূহের সুনিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সুসমন্বয়ে পরমচেতনার প্রকৃত উপলব্ধি সম্ভব।

পঞ্চেন্দ্রিয় আমাদের দৃশ্যানুভূতি, শ্রবণাভূতি, ঘ্রাণানুভূতি, স্বাদানুভূতি এবং স্পর্শানুভূতি তৈরি করে। মস্তিষ্কের কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র এই পঞ্চেন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ আমরা কীভাবে, কতক্ষণ, কতটুকু কোনো অনুভূতি পাবো তার নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। বিষয়টি আপাত জটিল মনে হলেও কতগুলি সহজ অভ্যাসে অতি সহজে পরমচেতনাকে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব।

কিন্তু কিভাবে?কবিতায় পরমচেনার অনুভবকে তুলে ধরার জন্য কয়েকটি বিষয়ে ধারণা তৈরি প্রয়োজন। কিছু অভ্যাসের প্রয়োজন। এ বিষয়ে নানা পথ আছে। জগৎ ও সৃষ্টি সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি অন্যতম পথ ‘মহাভূতবাদ’। এটি ‘ভূতবাদ’ বা ‘পঞ্চতত্ত্ববাদ’ নামেও পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কেবল পাঁচটি উপাদানের খেলা। এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান পঞ্চভূত বা পঞ্চমহাভূত নামে পরিচিত।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, লেখকের ভাষায়,

  • পৃথিবীর গুণ : অস্থি, মাংস, নখ, ত্বক ও লোম।
  • জলের গুণ : শুক্র, শোণিত, মজ্জা, মল, মূত্র।
  • অগ্নির গুণ : নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও আলস্য।
  • বায়ুর গুণ : ধারণ, চালন, ক্ষেপণ, প্রসারণ ও সঙ্কোচন।
  • আকাশের গুণ: কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও লজ্জা।

জল থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি। পঞ্চভূত সমস্ত সৃষ্টির মূল এবং সব সৃষ্টিই এই পঞ্চভূতে বিলীন হয়।’

এইজন্যই হয়তো, প্রাচীন চিন্তাবিদগণ এই পঞ্চভূতকে যথাক্রমে ক্ষিতি (মাটি বা পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) বলে নির্দেশ করেছেন। তাঁদের মতে জীবন ও বস্তুজগতের মূল এই পঞ্চভূত। পঞ্চভূতই এই মহাবিশ্বের যে কোনো শারীরিক উপাদানের সংমিশ্রণ। সমস্ত মহাজাগতিক শক্তিকে আত্মস্থ করতে পারলেই সৃষ্টির উৎসকে উপলব্ধি করা যায়।
কবি এই পঞ্চভূতকে উপলব্ধি করতে পারলে বা আয়ত্তে আনতে পারলে তিনি কবিতা সৃষ্টির উপরেও একধরণের বিশেষ কর্তৃত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন। সত্য এই যে, পঞ্চভূতের কেবলমাত্র একটিমাত্র উপাদানের গুণকে আয়ত্ত করলে প্রকৃত কবি হয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলেই লেখকের ধারনা।তাই সার্বিক অনুধাবন এবং আয়ত্তাধীন কৃৎকৌশলের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন লেখক। অধিকাংশই পৃষ্ঠা জুড়েই তাই প্রাজ্ঞ পরামর্শ, কখনো কখনো সংবেদী ছত্র…
শেষ করি, খুব প্রিয় দুটি লাইন দিয়ে,
‘আল্পনা আঁকা পাখিদের চোখের মাঝে, নোনা স্বপ্নের ঘুম।’
অথবা, ’নিভৃতে শুষে নিই শান্ত সূর্য। সূর্যাস্ত মাখা লাল সমুদ্র। এক চুমুকেই চিনে ফেলি দূর তারাদের চিঠি। নোনা ঢেউ-এর হাতছানি। সরলরেখা ছুঁয়েছে যে সবুজ, সৈকত মাখা সন্ধ্যেতে।’
কামনা করি, বইটি বহুপঠিত এবং পাঠকপ্রিয় হোক, এমন গবেষণাধর্মী বইপত্র যতো বেশি লেখা হবে, পড়া হবে, আখেরে সমাজেরই পক্ষে তা কল্যাণকর। শুভেচ্ছা অন্তহীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *